Wednesday, May 17, 2017

আমাদের গানের গল্প | ভাষা বন্ধকালে | Bhāṣhā bandhakālē

আমাদের গানের গল্প 

ইন্দ্রনীলের কথা 

(১) 
বেলা একটা বাজে, পাততাড়ি গোটাচ্ছি, শনিবারের বারবেলা, বাড়ি ফিরবো। এমন সময় শুভদীপ ঢুকে ধপ করে চেয়ারে বসে বলল, “বুঝলে হে কবি, কিনে ফেললাম।” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী, ছাতা?” কয়েকদিন পরপর বৃষ্টি হওয়ায়, ছাতার কথাই প্রথম মাথায় এল। 
“দুর, কী ছাতার মাথা! পিয়ানো, হে পিয়ানো। একটা ডিজিটাল পিয়ানো।” 
“তুমি লিখবে, আমি সুর দেব, তাতে গান হবে, আর তারপরে লোকে গালি দেবে। আমাদের গালি দেবার একটা সুযোগ করে দেওয়া যাবে। কি বল?”, বলে শুভদীপ খিকখিক করে হাসতে লাগল। 
“কী যে হাবিজাবি বলছ। আমি হলেম গিয়ে কবি, তাও আবার আঁতেল কবি, আর আমি নাকি লিখব গান! বিমূর্ততার গুঁতো খেয়ে তো লোকজনের পালাই পালাই অবস্থা হবে। তখন আর শুধু গাল দেবে না, তার সাথে ক্যালাবেও,” আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম। 
“তুমি তো আর সেই কবিতা লিখবে না, যা পড়ে লোকে মাথা চুলকে দু দিন পরে বলবে ‘কী ভালো কবিতা’। লিরিক তো আর কবিতা নয়।” 
“সেটাই তো চাপ। নিজের জায়গা থেকে বেরিয়ে লেখা। তুমি আমার ফেঁসে যাবার রাস্তাটা পরিষ্কার করে রাখছ।” 

(২) 
এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের গানের প্রস্তুতি। গত বছর শীতকালে। তবে এতো শুধু আমাদের গান নয়, সোমা আর কবিতা ছাড়া এই গান কোনদিন সম্ভব হত না। শুভদীপরা তখন ক্যাম্পাসের বাইরের এক বাড়িতে ছিল। ডিসেম্বর যখন এল মোটামুটি আমরা ঠিক করি যে এবার শুরু করা যেতে পারে। তা ভালো কথা – আমি লিখব, শুভদীপ সুর দেবে, সোমা গাইবে আর কবিতা পুরো প্রডাকশনটার দায়িত্বে থাকবে। ইতি মধ্যে শুভদীপ আমার কানের কাছে রোজ রীতিমত ক্যানেস্তারা বাজাতে শুরু করল – “সহজ কিছু লিখো।”

আমি বললাম, “তা কেন? এমন কিছু লিখব যা একটু নতুন হয়।”
আপনারাই বলুন, অ-য় অজগর আসছে তেড়ে, আমটি আমি খাব পেড়ে, এরকম কি লেখা যায়! তা আমি মোটামুটি একটা খসড়া তৈরি করে দেখাতেই হল বিপত্তি। শুভদীপ ‘হে ভগবান!’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। 



“আমার মনে হয় শব্দ গুলো কেমন যেন ঝুল ঝেড়ে বের করা।” 

“তা বটে, কিন্তু আকাশের চাঁদের যুগ ছাড়িয়ে, মিনিবাস, ডটকম, দুধ খাওয়া ভালো ছেলে পেরিয়ে, ফড়িং, টানেল হয়ে যখন মোটামুটি যখন আমরা দিকভ্রান্ত যে টালার দিকে যাবো না টালির দিকে যাব, তখন মোটামুটি কোনও দিকে না গিয়ে, আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির দু ফোঁটা চোখে পড়লে মন্দ হবে না। সে জল চোখের জল না মেঘ থেকে পড়ল সে খোঁজের কী দরকার বল?” 

“বাপরে, এই হচ্ছে সমস্যা, কী বললাম আর কী নিয়ে কাব্যি করলে।” 

“আমি ভাই এ জন্মে এসব শব্দ গানে শুনিনি। গান ছাড়, কানে শুনেছি কিনা তার ঠিক নেই। ‘স্বপ্রজনন’, ‘অনিমিখ’, এ সব ভাই গলা দিয়ে নামছে না, আটকে যাচ্ছে। ওরে বাবা এ আবার কী? শুরুই হচ্ছে - ‘এভাবে নরম পেয়ে জীবন’। এর মানে কী, নরম আবার জীবন পায় নাকি! এ তো দেখছি ভরপুর আঁতলামি। আমি এই লেখার দায়িত্ব নিতে পারছিনা। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ করে রাখা ভালো।” 

উত্তেজনা কমলে, দুদণ্ড হাঁপ ছেড়ে বলল, “লোকে বুঝবে তো?”

আমি বললাম, “না বোঝার তো কিছু দেখছি না। আর সব সময় শিল্প না বুঝলেও চলে, সঠিক অনুভবটাই আসল।” 

“বেশ। তা দাও দেখি, কিছু করা যায় কিনা। একটু পরীক্ষাই না হয় করা যাক। এমন সুর করব যা ভারতীয় শ্রোতার কাছে অচেনা। যেখানে যন্ত্র আর সঙ্গতের জন্য নয়, গলা আরকটি যন্ত্রের মতন। সব মিলিয়ে হবে গান, কেউ প্রাধান্য পাবে না।” 

সোমার কথা 

শুভদীপদা ট্র্যাকটা কাল রাতে ইমেল করে পাঠিয়েছে। সকালে ফোন করে বলল, “প্র্যাকটিস কর সোমা কালকে শুনব।” কিন্তু প্র্যাকটিস যে কী করব সে ভেবেই অস্থির হয়ে যাচ্ছি। এরকম কঠিন অবস্থায় তো কখন পড়িনি। এমনি গান গাওয়া আর রেকর্ডিংয়ের জন্য গান গাওয়া তো এক নয়। পাঁচটা ট্র্যাক চলছে তার মধ্যে গলা মেলানো কি সোজা? ঘর থেকে বেড়িয়ে ভাবলাম উবেরে করে অফিসে যাবার সময়টা কাজে লাগানো যাবে। আন্ড্রয়েড-এ ভয়েস রেকর্ডিং করা মটেই সোজা নয়, সে তো আমি জানি, লোকে যতই বলুক ভালো গলা। গাড়িতে উঠে দেখলাম এইরে হেড ফোনটা বাড়িতে ফেলে এসছি। অগ্যতা কী আর করা যাবে। আস্তে করে ফোনে ট্র্যাকটা চালিয়ে গাইতে লাগলাম। গাড়ি যখন টলিচৌকি পার হল, তখন এক ভারি মজার ঘটনা হল। ড্রাইভার সাহেব পিছন দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “কী সুন্দর সুর দিদি, কথাগুলোর মানে কী?” হায়দ্রাবাদের ড্রাইভার, বাংলা জানে না, তাই সে মানে জানতে চেয়েছে। আমার মনটা হটাৎ খুব ভালো হয়ে গেল। আমাদের এই এত মাসের পরিশ্রমের ফসল একজন বাইরের লোকের প্রথম ভালো লাগল। আরও ভালো লাগল অচেনা ভাষা হলেও সে জানতে চাইছিল কথার মানে কী, কথার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়নি, এমনকি এক ভিনদেশীর কাছে। এই নানান ভাবনার সাথে গাড়ি এগিয়ে চলতে লাগল, গান ও শহরের মধ্য দিয়ে। 

কবিতার কথা 

আমার সাদা বাংলায় কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু পিকনিককে বনভোজন বললে মুশকিলে পড়ে যাই। (তবু গর্বের কথা, বাংলাটা আমি অন্তত শেক্সপীয়রের থেকে ভালো জানি।) সে যাই হোক, গত শীতে ইন্দ্রনীল যে গানটা লিখলো, সেটা আমার মাথার মাইল খানেক উপর দিয়ে গেল। শুভদীপকে মানে জিজ্ঞাসা করতে এমন চোখ উল্টোলো যে আশাই ছেড়ে দিলাম মানে বোঝার। সে এক বিপদ। মানে বুঝিনা, কিন্তু মত দিতে হয় – ও যখন জিজ্ঞেস করে ‘এ প্যারার সুরটা চলবে?’, তখন বুঝি না বুঝি, কিছু বলতে হয়, না বললে ক্ষেপে যাবে। কিন্তু, ধীরে ধীরে, হাজার বার শুনতে শুনতে, কোন সময় জানি গানটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কথা বুঝি আর নাই বুঝি, মনে এক ছবি ভেসে উঠল। এক এক করে নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট জোড়ে, আর সে ছবিতে রং লাগে। একই সঙ্গে সোমার গলার পরিবর্তন-ও দেখলাম। 

এসব কথাই মনে ভিড় করে এলো, যখন একদিন শুভদীপ ঘোষণা করল, ‘মিক্সিং শেষ, এবার ভিডিওটা শেষ কর।’ সাদা-কালো আর কিছুটা রঙ – এ দিয়েই আমি ধরতে চেয়েছি মনের সেই ছবিটাকে। 

শুভদীপের কথা 

গানের কথা নিয়ে আর বললাম না, ইন্দ্রনীল অনেক বলেছে। আর নিজের সুর নিয়ে বলা আমার পক্ষে খুব মুশকিল। কল্পনা কি সবসময় বলে বোঝানো সম্ভব? তাই ওসব কথা থাক, বরং একটা অন্য কথা বলি। ২০১৭র মে মাস, আমাদের গান আর তার ভিডিও মোটামুটি ভাবে তৈরি। টেবিলের পাশে বসে কবিতা দেখলাম শেষ বারের মত দেখে নিচ্ছে সাব টাইটেলগুল ঠিক ঠিক টাইমে পড়ছে কিনা। 

“বুঝলে কবিতা, গানটা শোনার পর যে সমালোচনাটা সবার কাছ থেকে আসছে সেটা আমি আগেই জানতাম। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের সাথে আমদের পরিচয়টা খুবই কম। ভারতীয় সঙ্গীতের ধারায় সাধারণতঃ গানটা প্রধান হয়। আর বাকি সব যন্ত্র সঙ্গতের কাজ করে। বাকি পৃথিবীর ক্ষেত্রে সেটা অনেকাংশেই সত্যি নয়, যেখানে সব কিছু নিয়ে গান। তাই এই ফিডব্যাকটা আসবে সেটা ভেবেছিলাম।”
 

“তুমি কি সবার কথা শুনে যন্ত্রের ব্যবহার কমানোর কথা ভাবছো নাকি?” 

“না। আমার মনে হয়না সেটা করার দরকার আছে। তবে সবার মত পেয়ে বেশ ভালই হয়েছে। গানটা যে আমাদের পরিচিত লোকজনদের ভাল লেগেছে সেটাই আনন্দের।” 



এ যে গান, তা আমাদের নিজেদের আনন্দের জন্য। আর সেই আনন্দ আমরা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই। এই যে আমরা সবাই মিলে হৈ চৈ করছি, সেটাই পাওনা।



9 comments:

  1. এই দ্যাখো দেকি, আমি ই প্রথম কমেন্টকারী! শুভদীপ দা, তোমার শ্রীচরণে কোটি কোটি, শতকোটি প্রণাম, হামাগুড়ি আর সবশেষে মিষ্টি দেখে হামি! ইন্দ্রনীল দার প্রজননে সুরের ইয়ে পরানোর মতো সাহস স্বয়ং পঙ্কজ মল্লিক মশাই এর পর বঙ্গদেশে (এমন কি বঙ্গদেশ-জাতক ) আর কেউ দেখতে পারবে, এ যে শাকিরার ভারতনাট্যমের চেয়েও অভাবনীয়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধন্যবাদ ভায়না

      Delete
    2. তা যা বলেছ ! সাহসই বটে। :)

      Delete
  2. ফাটাফাটি চালিয়ে যাও

    ReplyDelete
  3. This is really one of the best possible synchronization of lyrics and music. Truth be told, I am mesmerized.

    ReplyDelete
  4. Also hat off to Soma also for such a nice singing!

    ReplyDelete
  5. বাঃ ... বাংলা গানে আবার নতুন নিরীক্ষার জোয়ার এল বলে। আরো হইচই চাই। চরৈবেতি ...

    ReplyDelete

HoiChoi | হৈচৈ - The Channel

Visit us @  https://www.youtube.com/c/HoiChoiChannel List of Videos ( Click here to play them all ) The Thirsty Crow Song - Fun Sin...